‘আমার শুধু এই তুমিটাই চাই’ পাণ্ডুলিপি থেকে পাঁচটি কবিতা
কবিতার শব্দে আমার তুমি
জানো
আজকাল আমি আর কবিতা লিখতে পারিনা
কবিতা লিখতে গিয়ে আমি লিখে ফেলি তোমাকে,
কবিতার শরীরে জড়াতে পারিনা শব্দের চাদর
অথচ তুমি কাছে এলেই আমি জড়ো করি হাজারো না বলা শব্দের বহর।
কী অদ্ভুত তাই না?
শ্রাবনের অঢল ধারায় এখন আমি ঢেউ তুলতে পারিনা,
শুনতে পারিনা কবিতার মাদল,
অথচ কাঁপা কাঁপা হাতে অবলীলায় আমি এঁকে যাই আমাদের গোপন প্রণয়ের আদল।
কবিতা লিখা বুঝি এতোটাই কঠিন?
কবিতা মানেই বেশামাল ছন্দদের পশরা সাজানো ভীষণ কঠিন, দুর্বোধ্য,
অথচ তোমার সমুদ্রসম গভীর চোখে তাকিয়ে আমি লিখে যাই জন্মান্তরের মহাকাব্য ;
জানো, আমি যতটা তোমার হতে পেরেছি ততটা পারিনি হতে কবিতার।
এক অনুর্বর কলমে শত চেষ্টা করেও জন্ম দিতে পারিনি কবিতার ভ্রুন,
অথচ দীর্ঘ অপেক্ষার পর জন্ম দিয়েছি আমাদের নিষ্পাপ ভালোবাসার অঙ্কুর।
সত্যি কী ভীষণ অদ্ভুত তাইনা?
আমি তোমাকে ছুঁতে পারলেও পারিনি কবিতার শরীর ছুঁতে,
তীব্র বেদনা আর বিষন্নতায় দিকভ্রান্ত হয়ে আশ্রয় পাইনি কবিতার ঘরে ;
অথচ অভিমানে রক্তাক্ত হৃদয়ে, ক্লান্ত দেহে ঠাঁই নিয়েছি তোমার দুয়ারে।
আচ্ছা, কবিতা বুঝি এতোটাই কঠিন?
কবিতা আমাকে ভাঙতে পারেনি
আমিও পারিনি কবিতাকে আঁকড়ে ধরতে,
অথচ তোমার স্পর্শে আমি রোজ রোজ ভেঙেছি
মেতেছি অসম এক গল্প লিখতে।
ওগো বলোনা,
কবিতার মন কী তোমার থেকেও অসীম?
আমি কবিতা বলতে বুঝিনি শব্দের গায়ে শব্দের প্রলেপ,
ছন্দের পায়ে পায়ে হেঁটে চলা
বুঝিনি অনুভুতিদের ছাঁচে ফেলে শুরু থেকে শেষ প্রান্তে পৌঁছে যাওয়া।
আমি কবিতা লিখতে গিয়ে শুধু লিখেছি তোমাকে,
কবিতার নামকরণে আমি নিজেকে হারিয়েছি তোমাতে-আমাতে;
আমি কবিতা লিখতে গিয়ে শুধুই লিখেছি
একান্তু আমার ‘একটা তুমি’ কে।
এই তুমিটাই চাই
অভিমানী আমি রাগটাও ভীষণ
ছুঁড়বো বালিশ, ফেলবো চোখের জল,
করবো নালিশ গাল ফুলিয়ে
তোমার সাথে কোনো কথা নাই;
তবুও আমার শুধুই - এই তুমিটাই চাই।
ঝগড়া হবে, রান্না বাটি বন্ধ রবে
কথারা সব চুপটি হবে,
চায়ের কাপে অভিযোগের ঝড় উঠবে
পাশাপাশি রবো তবু কোথাও তুমি নাই;
তবুও আমার শুধুই - এই তুমিটাই চাই।
আলতো করে চুমু ছাড়া একটা সকাল এমন হবে
মন খারাপের বেলা গুলো উদাস মনে
একলা একা জড়িয়ে রবে;
অশ্রু চোখে আবছায়া এক তোমায় খুঁজে পাই
তবুও আমার শুধুই - এই তুমিটাই চাই।
অফিস ফেরত বিবস বিকেল
আধখানা ঘর শূন্য রবে,
বাকহীনতার গল্পগুলো মন খারাপির সঙ্গ নেবে
অবুঝ তুমি হাত বাড়াবে কোথাও আমি নাই;
তবুও আমার শুধুই - এই তুমিটাই চাই।
আকাশ ছোঁয়া রাগের তাপে, একটু নাহয় বৃষ্টি হবে
আহ্লাদ আর আব্দার সব বালিশ চাপায় লুকিয়ে রবে,
আধভেজা এক আঁচল জুড়ে তোমার গায়ের গন্ধ পাই;
তবুও আমার শুধুই - এই তুমিটাই চাই।
রাত্রি হলেই বিছানা বালিশ এঘর ছেড়ে ওঘর রবে
তোমার বুকে জড়িয়ে থাকার অভিমানী কান্না হবে,
কাজল চোখের বায়না হবে, তুমি কোথাও নাই;
তবুও আমার শুধুই - এই তুমিটাই চাই।
রাগ, অভিমান, ঝগড়া আর জলোচ্ছ্বাসের ঢেউয়ের তরে
পুড়বো আমি, জুড়বো আমি - আমার হয়েই তুমি রবে
হাজার ব্যথার মধ্যখানেও আমি শুধু তোমায় খুঁজে পাই;
তবুও আমার শুধুই - এই তুমিটাই চাই।
তোমাকে দেখবো বলে
তোমাকে দেখবো বলে এক উত্তাল সমুদ্র পুষে রাখি চোখে
আমি দুঃখদের প্রস্ফুটিত হতে দেখি রোজ আতুর ঘরে ,
আলসে রোদের মতোন আমি ছুঁয়ে থাকি তোমার নির্লিপ্ততা
আমার কাব্যে লিখে রাখি আমার আমি জুড়ে অসম্পূর্ণতা ।
তোমাকে দেখবো বলে
আমি দিনকে রাত আর রাতকে খুব গোপনে অহর্নিশ জাগিয়ে রাখি পাশবালিশটা,
নিঃসঙ্গতাকে জাপটে ধরে আমি নোনাজলের হিসেব করি আমার যোগ বিয়োগের খেরোখাতা।
তোমাকে দেখবো বলে
আমি চলে যেতে যেতেও থমকে দাঁড়িয়ে পিছুটানে হাত বাড়াই ,
শূন্য চোখে ভঙ্গুর হৃদয়ে অলকানন্দার শহরে আমি রোজ তোমার অপেক্ষা করে যাই।
তোমাকে দেখব বলে
জড়ো করি গত হওয়া দিনে অগোচরে ভুলে যাওয়া ছোঁয়াহীন সাজ,
অচেনা শহরের অলিতে-গলিতে আমি বিলি করি তোমার নামের রুগ্ন স্মৃতির কারুকাজ।
তোমাকে দেখব বলে
রোজ সাদা কালো মেঘেরা বিরামহীণ পুড়ে যায় আমার ভেতর ঘরে,
এভাবেই আমি চিতার ছাই হয়ে মিশে যাই বৃষ্টিস্নাত কোন এক রাতে।
তোমাকে দেখব বলে
রং বেরং এর অপেক্ষা দিয়ে আমার সাদা কালো দুয়ার জুড়ে সাজিয়ে রাখি আলপনায়,
আমি রোজ নিরঙ্কুশ মিথ্যের গায়ে আদর সোহাগ লেপ্টে ঘর বাঁধি অলীক কল্পনায়।
আজন্ম কারাবাস
আমার পৃথিবী জুড়ে ‘তুমি’ বলতে বুঝি
শিল্পমানবীর কাঙ্খিত সেই প্রেমিক,
যাকে ছাড়া থমকে যায় সময়ের কাঁটা
নিঃশ্বাসের গায়ে লেগে যায় কার্ফ্যুইউ,
বিরামহীন বাক্যরা মেনে নেয় নিরবতা।
তুমি সেই মানবীর প্রেমিক
যাকে ছাড়া তার সত্তা আধেক,
সমস্ত পৃথিবী জুড়ে শূন্যতা
বিবস দুপুর, ক্লান্ত বিকেল আর
রাত্রির কোলাহলে অসাড় নিরবতা।
সাদা কালো ক্যানভাসে আঁকা
এক শৈল্পিক নারী সত্তা,
যার চাহনীতে গোটা ব্রহ্মাণ্ডের খরতাপ
অভিমান মানে এক সমুদ্র কান্না
কখনও আবার সূর্যদেবীর মতোই প্রতাপ।
তুমি সেই প্রেমিক
যার পাজরে বাঁধা এক শিল্পমানবী
সাত জনমের প্রনয়িনী রাধিকা,
তার প্রার্থনার চাদর মানেই 'তুমি'
ভোরের অমিয় থেকে রাত্রির যবনিকা।
যে মানবী নোনাজলে বাঁধে এক ছটা রোদ্দূর
কখনও বা সে নিভে যাওয়া পোড়া ধূপ,
তোমাকে কাছে পাবার তীব্রতায়
যার বুকে জাপটে ধরে অসুখ;
তুমি সেই শিল্পমানবীর প্রেমিক পুরুষ
নিয়তির দ্বার থেকে ছিনিয়ে নেয়া
কাঙ্খিত এক টুকরো সুখ।
ঝরনার শিঞ্জন, নূপুরের ছন্দে যার লাজ
নাকছাবির মোহ কিংবা গাঢ় কাজলের আড়ালে যার বাস,
তুমি সেই প্রেমিকার অপেক্ষমান তৃষ্ণার্ত প্রেম
তোমার নিষ্পাপ অনুভূতিতে সৃষ্টি এক শিল্পমানবী;
তোমার মাঝেই যার ‘আজন্ম কারাবাস।’
কেমন করে বাঁচো?
মানুষ হয়ে জন্ম নিয়েও
আমার হলো পাখি হবার সাধ,
অবাধ আকাশ মুঠোয় নিবো
মাঝে কাঁটাতারের বাঁধ।
মানুষ আমি তুচ্ছ তবু
কঠোর শৃংখলাতে বাস,
ডানা মেলে উড়তে মানা
বদ্ধ খাঁচাই যেনো আজন্ম কারাবাস।
একটাই জীবন একটাই আকাশ
তবুও অন্যের কাছে দাস,
কি বা হলো মানুষ হয়েই
যদি ইচ্ছে গিলে যাস।
পারবে দিতে আরেক জনম
উড়তে দিবে তেপান্তর?
নাইবা যদি পারোই তবে
কোন দায়েতে বাঁধো অবান্তর?
প্রেমে বাঁধি, মায়ায় থাকি
আমি খাঁচার পাখি নই,
মানুষ আমি নিজ সত্তায়
আমার 'আপন' মানুষ কই?
ডানা ভেঙে লুটিয়ে পড়ি
ক্ষত মনে আঁকড়ে ধরি,
মূল্য কোথায় এই জীবনের
যেনো শূণ্য, অচল কানা কড়ি।
এ বাঁচা কি বাঁচা তবে
নিঃশ্বাস নামে মূল্য ধরো,
আত্ম বিবেক নিলাম করে
বলো, তোমরা কেমন করে বাঁচো?
এ্যানি আক্তারের ‘আমার শুধু এই তুমিটাই চাই’ কাব্যগ্রন্থটি ২০২৩ গ্রন্থমেলায় ‘পুনশ্চ’ প্রকাশনি থেকে প্রকাশ হচ্ছে।