বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য কী ভয়ানক দম্ভোক্তি!
ভাস্কর্য ইতিহাসের উপস্থাপন মাত্র, ধর্মীয় কোনো আচার-অনুষ্ঠানের সঙ্গে কোনোভাবেই সম্পৃক্ত নয়। তাহলে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণের বিরোধিতা কি ধর্মের অপব্যাখ্যার কারণে, নাকি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত? কারণ যাই হোক, তা অগ্রহণযোগ্য এবং সমাজের জন্য বিপদজনক।
বাঙালির ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ঘটনা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ এবং শ্রেষ্ঠ অর্জন বাংলাদেশের স্বাধীনতা। আর এ স্বাধীনতার মহানায়ক সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসনামলে প্রায় ২৩ বছর তিনি বাঙালির অধিকার আদায়ের জন্য আপসহীনভাবে লড়াই সংগ্রাম করেছেন। দীর্ঘ ১৩ বছর কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্ঠে বন্দিজীবন কাটিয়েছেন কিন্তু বাঙালির অধিকার আদায়ের প্রশ্নে আপস করেননি। অর্থ-বিত্ত-ক্ষমতার মোহ কিংবা ফাঁসির রজ্জু কোনো কিছুই বাঙালির অধিকারের চাইতে তার কাছে বড় ছিল না।
ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে বাঙালির অধিকার আদায়ের সংগ্রামের প্রতিটি বাঁকে তিনি জাতিকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। ১৯৬৬ সালে ঐতিহাসিক ৬ দফা ঘোষণা করে তিনি বাঙালির মুক্তির প্রকৃত পথটি দেখিয়েছিলেন। সাড়ে সাত কোটি বাঙালিকে একটি ছাতার নিচে সম্মিলিত করেছিলেন। বাঙালি জাতির প্রতিটি সদস্য তার আপনজন যেন পরিবারেরই সদস্য। সে কারণে তিনি হাসতে হাসতে ফাঁসির কাষ্ঠে দাঁড়াতেও কুণ্ঠিত ছিলেন না। দাবি ছিল শুধু একটাই- ‘মরার পরে আমার মৃতদেহটা আমার বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিও’।
বাঙালির এ শ্রেষ্ঠ সন্তান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী পালিত হচ্ছে দেশব্যাপী। করোনা সংক্রমণের কারণে আনুষ্ঠানিকতা সীমিত হলেও মানুষের হৃদয়ের গভীরতা আর উষ্ণতায় তা ঠিকই পালিত হচ্ছে সাড়ম্বরে। কিন্তু হঠাৎ বিস্মিত হয়ে থমকে দাঁড়াতে হলো। ঢাকায় একটি সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী প্রকাশ্যে সভা করে জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে জাতির জনকের একটি ভাস্কর্য নির্মাণের পরিকল্পনার বিরোধিতা করে। এমনকি এ কথাও বলে যে, ভাস্কর্য নির্মাণ করা হলে তা ভেঙে বুড়িগঙ্গায় ফেলে দেওয়া হবে। কী ভয়ানক দম্ভোক্তি।
স্বাধীন বাংলাদেশে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতিকে হেয়-অপমান করার এ ধরনের দুঃসাহসে স্তম্ভিত সবাই। এ শুধু বঙ্গবন্ধুকে নয় বাংলাদেশকে অস্বীকার করা। বাঙালি জাতিসত্তা এবং হাজার বছরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে ধুলায় মিশিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা।
আমরা সবাই জানি ভাস্কর্য একটি জাতির ইতিহাস ও ঐতিহ্যের অন্যতম স্মারক। হাজার বছরের লড়াই-সংগ্রামের বীরত্বগাঁথা এবং শ্রেষ্ঠ মনীষীদের অবদানকে নতুন প্রজন্মের পরম্পরায় জীবন্ত করে রাখা। এই ভাস্কর্য নির্মাণের সঙ্গে ধর্মের কোনো সম্পর্ক বা বিরোধ নেই। হাজার বছরের মুসলিম সভ্যতার দিকে যদি আমরা তাকাই তাহলে দেখব ইউরোপ, এশিয়া এবং আফ্রিকার দেশগুলোতে ইসলামি সংস্কৃতির নানা উপস্থাপনের মধ্যে ভাস্কর্য অন্যতম প্রধান হিসেবে স্থান করে আছে। যারা ভাস্কর্যকে ইসলামবিরোধী বলে সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষকে বিভ্রান্ত করছেন- তারা কি অপরাপর ইসলামিক দেশগুলোর দিকে একবার তাকিয়ে দেখেছেন?
ইসলামের বীরত্বগাথা এবং বিভিন্ন অঞ্চলের ইতিহাস ঐতিহ্যকে তুলে ধরার জন্য মুসলিম প্রধান দেশগুলোতে অসংখ্য ভাস্কর্য নির্মিত হয়েছে শত শত বছর ধরে। পাঠকদের উপলব্ধির জন্য তার কয়েকটি এখানে তুলে ধরছি-
সৌদি আরব
মরু প্রধান সৌদি আরবে উট এবং ঘোড়ার প্রচলন তাদের প্রাত্যহিক জীবনেরই অংশ। সৌদি আরবের বিভিন্ন অঞ্চলে উট এবং ঘোড়ার ভাস্কর্য রয়েছে। জেদ্দা নগরীতে মুষ্ঠিবদ্ধ হাত, মানুষের চোখ, মরুর বুকে উটের ভাস্কর্য রয়েছে।
ইরান
ইরানের বিভিন্ন শহরে অসংখ্য ভাস্কর্য নির্মিত হয়েছে। তেহরানে মহাকবি ফেরদৌসের ভাস্কর্য, ইরানের হামাদানে ইবনেসিনার ভাস্কর্য, তেহরানে ওমর খৈয়াম, কবি হাফিজের ভাস্কর্য, খোরাসানে নাদির শাহের ভাস্কর্য রয়েছে। ইরানে রয়েছে ‘আজাদি’ নামের একটি বিশাল স্বাধীনতা স্তম্ভ, যার ডিজাইনার হোসেন আমানত। ইরানের ইসলামি বিপ্লবের মূল নেতা আয়াতুল্লা রুহুল্লা খোমেনি ওরফে ইমাম খোমেনীর ভাস্কর্য এবং ম্যুরাল রয়েছে ইরানের বিভিন্ন শহরে।
সিরিয়া
মুসলিম রাষ্ট্র সিরিয়াতে রয়েছে অসংখ্য ভাস্কর্য। প্রয়াত শাসক হাফিজ আল আসাদের ভাস্কর্য রয়েছে বিভিন্ন শহরে। দামেস্ক নগরীতে রয়েছে মুসলিম সেনাপতি সালাদিনের স্মৃতি রক্ষায় ‘স্ট্যাচু অফ সালাদি’ নামের ভাস্কর্য।
মালয়েশিয়া
মুসলিম রাষ্ট্র মালয়েশিয়ায় নির্মিত হয়েছে অসংখ্য ভাস্কর্য। কুয়ালালামপুরে রয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে শহীদদের স্মরণে ১৫ মিটার উচুঁ ন্যাশনাল মনুমেন্ট। প্রতিকীভাবে সাতজন বীরের প্রতিকৃতির মাধ্যমে এই ভাস্কর্য নির্মাণ করা হয়। মালয়েশিয়ায় আরো রয়েছে মুরুগান মূর্তি, মার্জার মূর্তি এবং কনফুসিয়াসের মূর্তি।
পাকিস্তান
ইসলামিক রিপাবলিক অব পাকিস্তানের বিভিন্ন শহরে নির্মিত হয়েছে অসংখ্য ভাস্কর্য। লাহোরে বাদশাহী মসজিদের সামনে মেরি মাতার ভাস্কর্য, পাঞ্জাবের জং শহরে ঘোড় সওয়ারের ভাস্কর্য, লাহোরে ন্যাশনাল কলেজ অব আর্টসের সামনে অনেক ভাস্কর্য রয়েছে। এছাড়াও পাকিস্তানের জাতির পিতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ভাস্কর্য রয়েছে পাকিস্তানের বিভিন্ন শহরে।
আমি মাত্র কয়েকটি মুসলিম প্রধান রাষ্ট্রে নির্মিত ভাস্কর্যের কথা এখানে তুলে ধরলাম। অন্যান্য মুসলিম রাষ্ট্র কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত, তুরস্ক, ইরাক, ইন্দোনেশিয়া, মিশর, মরক্কো, আলজেরিয়া, লিবিয়াসহ প্রায় সব দেশেই ভাস্কর্য রয়েছে। এখন প্রশ্ন হলো, পৃথিবীর অন্যান্য মুসলিম রাষ্ট্রে এমনকি যে রাষ্ট্রগুলোর সংবিধান কোরআন ও সুন্নাহ অনুযায়ী প্রণয়ন করা হয়েছে- সেখানে ভাস্কর্য নির্মাণ যদি ধর্মবিরোধী না হয়ে থাকে, তাহলে আমাদের দেশে এ প্রচারণা কেন?
ভাস্কর্য ইতিহাসের উপস্থাপন মাত্র; ধর্মীয় কোনো আচার-অনুষ্ঠানের সঙ্গে কোনোভাবেই সম্পৃক্ত নয়। তাহলে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণের বিরোধিতা কি ধর্মের অপব্যাখ্যার কারণে, নাকি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত? কারণ যাই হোক না কেন, তা অগ্রহণযোগ্য এবং সমাজের জন্য বিপদজনক।
ধর্মের অপব্যখ্যা সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষকে বিভ্রান্ত করে সমাজে হিংসা-বিদ্বেষ সৃষ্টি করে। এক্ষেত্রে প্রকৃত আলেম এবং সচেতন নাগরিকদের এগিয়ে আসতে হবে। ইসলামের প্রকৃত ব্যাখ্যা সাধারণ মানুষের কাছে তুলে ধরতে হবে। সব ধর্মই সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং মানবিক বোধের কথা বলে। সুতরাং ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে যারা সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করতে চায় তাদের মুখোশ উন্মোচন করতেই হবে। আর যদি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য এবং একাত্তরের পরাজয়ের প্রতিশোধ নেয়ার জন্য বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণে বাধা প্রদান বা বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা হয় তবে রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিকভাবে তা মোকাবেলা করাই হবে বাঞ্ছনীয়।
লেখক: গবেষক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
আলোকিত রাঙামাটি