বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার অর্থনীতির মধ্যে তুলনা অবাস্তব এবং কল্পনাপ্রসূত
বিরোধী রাজনীতিবিদ, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি এবং মৌলবাদীদের একটি সমৃদ্ধ সংমিশ্রণ শ্রীলঙ্কাকে বিপর্যস্ত করা বিশাল অর্থনৈতিক সংকটকে পুঁজি করে বাংলাদেশের অর্থনীতির ভরাডুবি প্রত্যাশা করছে। আমি তাদেরকে বাংলাদেশের ভরাডুবি প্রত্যাশাকারী বলে মনে করি কারণ তাদের কথাবার্তা এবং কার্যক্রমে মনে হচ্ছে যে, তারা বাংলাদেশের ওপর এই ধরনের সংকট আসবার জন্য ঐশ্বরিক হস্তক্ষেপ প্রার্থনা করছে। ব্যাপক সামাজিক অস্থিরতা, সহিংস আন্দোলন এবং সম্ভাব্য সামরিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সরকারকে উৎখাত করাই তাদের একমাত্র আশা। কিন্তু তারা ভুলে গিয়েছে যে, কীভাবে তারা সেই ক্ষমতাসীন দলকে পরাজিত করতে পারে যাদের এক দশকের শাসনামলে বাংলাদেশ আশ্চর্যজনক অর্থনৈতিক পরিবর্তনের সাক্ষী হয়েছে!
এই ব্রিগেডের সদ্যসরা টিভি টকশো এবং সংবাদপত্রের কলামগুলিতে তাদের আবাস্তব অর্থনৈতিক জ্ঞানের প্রকাশ করে চলেছে। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টগুলিতে তাদের ‘জ্ঞানের মুক্তা’ থেকে উদ্ভূত যুক্তিতে স্পষ্টতার অভাব রয়েছে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ আবার সতর্ক করেছেন এই বলে যে, শ্রীলঙ্কার সংকট থেকে বাংলাদেশের শিক্ষা নেওয়া উচিত। এদের মধ্যে কেউ কেউ আবার দুই দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার মধ্যে মিলও খুঁজে পাচ্ছেন।
এই অবাস্তব দাবিদারদের এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের পক্ষ থেকে এই বলে সতর্ক করা হয়েছে যে, তারা ভুল উদাহরণের ওপর ভিত্তি করে বিষয়টি নিয়ে ভ্রান্ত এবং বিকৃত ব্যাখ্যা প্রদান করছে। এডিবি’র কান্ট্রি ডিরেক্টর এডিমন গিনটিং বলেছেন, বাংলাদেশের ঋণ ব্যবস্থাপনা এখন পর্যন্ত অনেক ভালো এবং শ্রীলঙ্কার মতো সংকট মোকাবিলা করার সম্ভবনা খুবই কম।
সম্প্রতি এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট আউটলুক (ADO) রিপোর্ট প্রকাশ করার সময় গিনটিং বলেছেন “বাংলাদেশের ঋণ ব্যবস্থাপনা খুবই বিচক্ষণ। কিন্তু শ্রীলঙ্কার ক্ষেত্রে সেটা ছিল না।” তিনি বলেন, “শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক সংকট যে বিষয়টির ওপর সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে সেটি হল যে একটি দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি পরিচালনা করা কতটা গুরুত্বপূর্ণ।”
শ্রীলঙ্কার সংকট থেকে বাংলাদেশ কী শিখতে পারে এই সংক্রান্ত সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে গিনটিং সাংবাদিকদের বলেন “সেখানে (শ্রীলঙ্কায়) সংকট হঠাৎ করে আসেনি। সেখানে নীতিগুলি সঠিক ছিল না।” এডিবি কর্মকর্তা আরও বলেন, “সংঘাত-পরবর্তী সময়ে শ্রীলঙ্কা ভালো করছিল, কিন্তু জিডিপি প্রবৃদ্ধি বাংলাদেশের মতো ভালো ছিল না।” তিনি শ্রীলঙ্কা সম্পর্কে আরও বলেছিলেন, “আপনি যদি আর্থিকভাবে শক্তিশালী না হন তবে প্রবৃদ্ধি হবে না।”
শ্রীলঙ্কা এক বছরেরও বেশি সময় ধরে আর্থিক সংকটের সম্মুখীন হয়েছে এবং বিদেশী মুদ্রার অভাবের কারণে দেশটি আমদানি বিল পরিশোধ করতে ব্যর্থ হয় বলে পরিস্থিতি সম্প্রতি আরও তীব্রতর হয়ে উঠেছে। মাত্র কয়েকদিন আগে সেখানকার বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে জনগণ রাজপথে নেমে আসায় দেশটির সকল মন্ত্রী গণপদত্যাগ করেন। বাংলাদেশ সম্পর্কে অবাস্তব পূর্বাভাসকারীরা এমনটাই আশা করছে যে, আমাদের দেশে যেন শ্রীলঙ্কার দৃশ্যকল্পের পুনরাবৃত্তি ঘটে। কিন্তু তারা জানে না যে, তাদের এই আশা পূরণ হবার সম্ভবনা খুবই কম।
বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কোভিড-১৯ মহামারীর সময়ে কিছুটা কমে যাবার পর আবারও বাড়ছে। এখন ৪৫ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছে। দেশের তৈরি পোশাক খাত বিকাশমান রয়েছে বিধায় রপ্তানি শীঘ্রই ৫০ বিলিয়ন ডলার স্পর্শ করার সম্ভাবনা রয়েছে। গত মার্চ মাসে বাংলাদেশের বাৎসরিক রপ্তানি প্রায় ৫৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ৪.৭৬ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে, যা এক মাসের রেকর্ডে সর্বোচ্চ, যদিও চলতি অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় ৩৩.৪ শতাংশ বেড়ে ৩৮.৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে।
দেশের রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যকে উদ্ধৃত করে করা মিডিয়া রিপোর্ট অনুযায়ী ২০২২ সালের মার্চ মাসে রপ্তানি আয় ৫৪.৮২ শতাংশ বেড়ে ৪.৭৬ বিলিয়ন ডলার হয়েছে যা ২০২১ সালের একই মাসে ৩.০৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছিল।
শ্রীলঙ্কার সংকট থেকে বাংলাদেশকে যে শিক্ষা নিতে হবে তা হলো অর্থনীতিতে বৈচিত্র্য আনা জরুরি। বাংলাদেশের রপ্তানি নির্ভর করে তৈরি পোশাক শিল্পের ওপর। অন্যদিকে শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক আয় নির্ভরশীল ছিল পর্যটন শিল্পের ওপর যা কোভিড-১৯ সংকটের সময় ভেঙে পড়ে। জ্বালানী এবং বৈদেশিক মুদ্রার অভাব, কোভিড-১৯ এর প্রবল প্রভাব এবং ইউক্রেইনের যুদ্ধ বর্তমান সংকটকে আরও ঘনীভূত করেছে সেখানে।
কিন্তু বাংলাদেশের কোভিড-১৯ ব্যবস্থাপনা ছিল পৃথিবীতে অনুকরণীয়। অবাস্তব দাবিদাররা লক্ষ লক্ষ মৃত্যু ভবিষ্যদ্বাণী করলেও মৃত্যুর সংখ্যা হাজারে সীমাবদ্ধ ছিল। উৎপাদন ও রপ্তানি উভয় ক্ষেত্রেই পোশাক খাতের দ্রুত পুনরুদ্ধারের ফলে আমদানি চাহিদা মেটাতে পর্যাপ্ত বৈদেশিক মুদ্রার সরবরাহ নিশ্চিত হয়েছে।
বাংলাদেশ এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। সামষ্টিক অর্থনৈতিক কর্মক্ষমতা এবং কূটনৈতিক আস্থা অর্জনের জন্য খাদ্য নিরাপত্তার গুরুত্ব অনেক। খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনের অর্থ হলো সামাজিক অস্থিরতা বৃদ্ধির প্রচেষ্টার সাফল্যের সম্ভাবনা সীমিত হওয়া।
খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনের মতোই বিদ্যুতের শতভাগ কাভারেজ অর্জন আওয়ামী লীগ সরকারের আরেকটি বড় অর্জন। অন্যদিকে শ্রীলঙ্কায় পর্যটকের সংখ্যা কমে গেছে কারণ পর্যটকরা দিনে ১০-ঘন্টা বিদ্যুৎবিহীন থাকতে পছন্দ করে না। শুধু কয়লার ওপর নির্ভর না করে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানোর জন্য পারমাণবিক কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার দিকে মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করে বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধির বাংলাদেশ সরকারের সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল। এটি আঞ্চলিক বিদ্যুৎ বাণিজ্যকে জোরালো এবং সফলভাবে প্রভাবিত করেছে বিধায় ভবিষ্যতের চাহিদা মেটানোর বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে পূর্ব ভারতের গ্রিডের মাধ্যমে নেপাল এবং ভুটান থেকে সস্তা জলবিদ্যুতের সরবরাহ নিশ্চিত করার সুযোগ তৈরি হয়েছে।
বাংলাদেশ সম্পর্কে অবাস্তব ভবিষ্যদ্বাণী করা লোকেরা শাসন ব্যবস্থায় পরিবর্তনের জন্য একটি পরাশক্তির হস্তক্ষেপ আশা করেছিল। র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন এবং এর কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা তাদের উৎসাহিত করেছিল, কিন্তু ইউক্রেইনের সংকট বিশ্বব্যাপী পরাশক্তিদের মনোযোগ এশিয়া থেকে অন্যত্র পরিবর্তন করতে বাধ্য করে। কার্যকরভাবে কোভিডকালীন দুর্যোগ সামাল দেওয়ার ফলে সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টির পরিকল্পনা ভেস্তে যায় কারণ মানুষের আবেগকে ব্যবহার করে অস্থিরতা সৃষ্টির আর কোনও উপাদান তাদের হাতে ছিল না। তাই এই দলটি মঙ্গল শোভাযাত্রাসহ পহেলা বৈশাখ উদযাপনে বাধা দেওয়ার একটি মৌলবাদী এজেন্ডাকে বাস্তবায়ন করার ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে। এভাবেই স্পষ্টত পাশ্চাত্যের দোসর এবং উগ্রবাদীরা এই সরকারের পতন ঘটানোর চেষ্টায় লিপ্ত হয় যে সরকারের হাত ধরে বাংলাদেশ অনেক অর্জন প্রত্যক্ষ করেছে।