পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি’র সন্ত্রাসবাদ
১৫ ফেব্রুয়ারি পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (পিসিজেএসএস)-এর প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী। অথচ এই সংগঠনটি পাহাড়ি-বাঙালির জীবনে যে ভয়াবহ সন্ত্রাসবাদের জন্ম দিয়েছে তা এককথায় দেশের সার্বভৌমত্ব বিনষ্টের অন্যতম দৃষ্টান্ত। সব ধরনের অপপ্রচেষ্টা ও অপকর্মের সঙ্গে তাদের নেতা-কর্মীরা জড়িত।
উল্লেখ্য, ১৯৯৭ সালে সম্পাদিত শান্তিচুক্তির পর থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি মূলধারার রাজনৈতিক দল হিসেবে আবির্ভূত হয় এবং বর্তমানে দলটির প্রধান হলেন মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার ছোট ভাই জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা)। তিনি একই সাথে চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্বে রয়েছেন। পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি শান্তি চুক্তির পূর্ণ ও যথাযথ প্রয়োগের জন্য আন্দোলন অব্যাহত রেখেছে এবং সরকার চুক্তির যথাযথ বাস্তবায়ন করছে না বলে অভিযোগ করে আসছে।তাদের এই অভিযোগ যে পুরোটাই মিথ্যা তা লেখাবাহুল্য। বরং পাহাড়ের মানুষ সকলেই তাদের চাঁদাবাজ ও সন্ত্রাসবাদে অতিষ্ঠ।
প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে বলা যায়, বাংলাদেশের জন্মের পর মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা ২৪ এপ্রিল ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের খসড়া সংবিধান প্রণেতাদের কাছে পার্বত্য চট্টগ্রামের স্বায়ত্তশাসনের দাবিসহ মোট চার দফা দাবি পেশ করেন। দাবিগুলো ছিল: (ক) পার্বত্য চট্টগ্রামের স্বায়ত্তশাসন এবং নিজস্ব আইন পরিষদ গঠন (খ) সংবিধানে ১৯০০ সালের রেগুলেশনের অনুরূপ সংবিধির অন্তর্ভুক্তি (গ) উপজাতীয় রাজাদের দপ্তর সংরক্ষণ (ঘ) ১৯০০ সালের রেগুলেশন সংশোধনের ক্ষেত্রে সাংবিধানিক বিধিনিষেধ এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালিদের বসতি স্থাপনে নিষেধাজ্ঞা আরোপ। দাবিগুলি সরকার প্রত্যাখ্যান করেছিল, এতে পার্বত্য অঞ্চলের মানুষের মধ্যে অসন্তোষ ও অসন্তুষ্টি সৃষ্টি হয়। ১৯৭৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রতিনিধি ও কর্মীরা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার নেতৃত্বে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (পিসিজেএসএস) প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমানে তারা পার্বত্য চট্টগ্রামের একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠী। কারণ প্রতিষ্ঠার সময় উপজাতিদের অধিকারের দাবি নিয়ে রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেও তার অন্তরালে রাষ্ট্র বিরোধী তৎপরতা, অব্যাহত চাঁদাবাজি, সশস্ত্র কার্যক্রম, হানাহানি, খুন-গুম করে সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রামকে অশান্ত করে আসছে।১৯৭৫ সালে পিসিজেএসএস এর সশস্ত্র সামরিক শাখা শান্তিবাহিনীর যাত্রা শুরু হয়। যদিও বিভিন্ন মাধ্যমের দাবি ১৯৭২ বা ৭৩ থেকে পিসিজেএসএস এর সশস্ত্র শাখা ছিল। তারা প্রথম রাষ্ট্রীয় সম্পদের উপর আক্রমণ শুরু করে ক্ষিরাম বন বিভাগের উপর হামলার মধ্য দিয়ে। এ হামলার মধ্য দিয়ে তারা তাদের উপস্থিতি এবং শক্তি সক্ষমতা জানান দেয়। এবং ১৯৭৭ সালে বান্দরবান সাঙ্গু নদীতে ৫ সেনা সদস্যকে গুলি করে হত্যার মধ্য দিয়ে তারা তাদের শক্তি ও হিংস্রতা প্রকাশ করে। মূলত তারা বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের একাত্তরের স্বাধীনতাকে মেনে নিতে পারেনি। তাই সদ্য স্বাধীন হওয়া রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে নিয়েছিল। পার্বত্য চট্টগ্রামে রাষ্ট্রের আধিপত্য এবং উপস্থিতি মেনে না নেওয়ার জন্য বিদেশি অনেক দেশের সরাসরি ইন্ধন ছিল।
অন্যান্য দেশের সহযোগিতায় তারা দ্রুত বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে নেওয়া দুঃসাহস প্রদর্শন করতে সামর্থ হয়। তথাকথিত শান্তিবাহিনী সাধারণত সরকারি বাহিনী ও বাঙালি বসতি স্থাপনকারীদের পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে বিতাড়িত করার লক্ষ্যে সন্ত্রাসী হামলা শুরু করে। শান্তি বাহিনীর সন্ত্রাসীদেরকে নিরস্ত্রীকরণ ও জে.এস.এসকে রাজনীতির মূল ধারায় ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যসহ উপজাতি জনগোষ্ঠীর চাওয়া-পাওয়া পূরণের অংশ হিসেবে ১৯৯৭ সালের ২-রা ডিসেম্বর সরকার একটি চুক্তি সম্পাদিত করে। এ চুক্তি জেএসএস সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা) এবং বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে সম্পাদিত হয়। চুক্তির পরবর্তীতে সময়ও জেএসএস তাদের সশস্ত্র শাখার তৎপরতা বন্ধ করেনি এবং সশস্ত্র সদস্যদের অস্ত্র নিরস্ত্রীকরণ করেনি। জেএসএস চুক্তির মধ্য দিয়ে সরকারের সঙ্গে ভাঁওতাবাজি করেছে এবং নিজেদের অবস্থান পাকাপোক্ত করতে চুক্তির ৭২টি ধরার- ৯৯ টি উপধারার সুযোগ-সুবিধা হাতিয়ে নিয়েছে। চুক্তির ৯৯ টি উপ-ধারার মধ্যে সরকার প্রায় ৬৯ টি সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন,১৫ টি আংশিক বাস্তবায়ন ও বাকি ১৫ টি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। পক্ষান্তরে জনসংহিত সমিতির নেতাদের শুধু দুটি ধারার কথা বলা হয়েছিল। একটি -তাদের সকল অস্ত্র আত্মসমর্পণ এবং দ্বিতীয়টি-সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ছেড়ে দিয়ে স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ফিরে আসা। কিন্তু তারা একটিও বাস্তবায়ন করেনি।
বর্তমানে সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রামে তথাকথিত শান্তিবাহিনীর সন্ত্রাসীরা বিভিন্ন দল-উপদলে বিভক্ত হয়ে চাঁদাবাজি, হানাহানি, রক্তরক্তি সংঘর্ষ ও অবৈধ অস্ত্রের জোর খাটিয়ে পার্বত্যাঞ্চলের জনজীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছে। পাহাড়ে সন্ত্রাসবাদ জেএসএস সৃষ্টি করেছে। এই জেএসএস পার্বত্য চট্টগ্রামের ৩৮ হাজার নিরস্ত্র বাঙালিকে হত্যা করেছে৷ ২৭টি গণহত্যা পার্বত্য চট্টগ্রামে চালিয়েছে৷ ভূষণছড়া, পাকুয়াখালী, লংগদুসহ ২৭টি গণহত্যায় নিহত হন প্রায় ৩৮ হাজার নিরীহ বাঙালি আবাল, বৃদ্ধা-বনিতা, সন্তানসম্ভবা নারী এবং অসংখ্য শিশু। একই সাথে জেএসএস এই সন্ত্রাসীদের হামলার শিকার হয়ে প্রাণ হারিয়েছে বহু নিরীহ উপজাতি নারী-পুরুষও। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাহাঙ্গামা ও জাতিগত ভেদাভেদ সৃষ্টি করে জেএসএস ইতিহাসে ঘৃণ্য গোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছে। অথচ পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান হিসেবে প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদায় দিব্যি বাংলাদেশের জাতীয় পতাকাবাহী গাড়ি ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বহন করে চলছে সন্ত লারমা। কিছুদিন আগ পর্যন্ত তার নিজস্ব জাতীয় আইডি কার্ড ও বাংলাদেশের পাসপোর্টও ছিল না। রাষ্ট্রদ্রোহী এই উপজাতি ব্যক্তিকে কেন আমরা লালন পালন করছি সে প্রশ্ন সামনে এসেছে গত দু’দশকে। পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে জেএসএস যে, সন্ত্রাসবাদ, অশান্তির দাবানল সৃষ্টি করেছে তা রাষ্ট্রদ্রোহীতার সামিল। এমনকি পার্বত্য চট্টগ্রামে ৩৮ হাজার বাঙালি হত্যার দায় ও সব ঘটনার দায় অবশ্যই জেএসএসকে নিতে হবে। এবং ইউপিডিএফসহ বাকী সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর অপকর্মের দায়ও জেএসএসকে বহন করতে হবে। কেননা জেএসএস সৃষ্টি হয়েছে বলেই অন্যান্য আঞ্চলিক সন্ত্রাসী দল গুলোরও তৎপরতা বেড়েছে।
২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসেই রামগড়ে পার্বত্য চুক্তি বিরোধী সন্ত্রাসী সংগঠন ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) প্রসীত গ্রুপের সন্ত্রাসীদের হামলায় ২ জন অটোরিক্সা চালক ও একজন কৃষি শ্রমিক গুরুতর জখম হয়েছেন। ১২ ফেব্রুয়ারির এই ঘটনার অনেক আগে থেকেই জেএসএস সন্তু সমর্থিত ‘হিল ভয়েজ নিউজে’ সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অপপ্রচার করতে দেখা গেছে। রাঙামাটি পার্বত্য জেলার জুরাছড়ি উপজেলার দুর্গম বনযোগীছড়া ইউনিয়নের ছোট পানছড়ি নামক এলাকা থেকে ৭ ফেব্রুয়ারি সেনাবাহিনী ৩ জনকে আটক করে। এর মধ্যে একজন আঞ্চলিক সন্ত্রাসী দলের চাঁদা কালেক্টর হিসেবে জানিয়েছে স্থানীয় গ্রামবাসী।একজন হত্যা মামলার আসামিকে আটক ঠিক কী কারণে করা হয় তা সবাই জানলেও জানে না ইউপিডিএফ-জেএসএস সংবাদমাধ্যমগুলো। বনযোগীছড়া ইউনিয়ন থেকে আটককৃত সুভাষ বিজয় চাকমা দীর্ঘদিন চাঁদাবাজি, অপহরণ, খুন-গুম এর মত ঘৃণিত কাজে জড়িত তার বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে।তাই তাকে আটক করা হয়। আটককালে তার কাছ থেকে একটি মিলিটারি চাকু উদ্ধার করা হয়।আঞ্চলিক সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো যে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে মানবাধিকার বিষয়ে অভিযোগ তুলেছেন তা সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং মিথ্যাচার।
বাস্তবিক অর্থে বললে সেনাবাহিনী সদস্যরা কোন নিরীহ মানুষদের হয়রানি বা আটক করেন না এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো ঘৃণ্য অপরাধ কাণ্ডে জড়িত নন।স্থানীয় জনসাধারণ দীর্ঘদিন সুভাষ বিজয় চাকমার চাঁদাবাজি ও ভয়ভীতিতে অতিষ্ঠ ছিল। সেনাবাহিনী কর্তৃক উক্ত সন্ত্রাসী আটকের খবর ছড়িয়ে পড়লে স্থানীয়রা স্বস্তি প্রকাশ করে এবং সেনাবাহিনীকে সাধুবাদ জানায়। ইউপিডিএফ-জেএসএস এর মত চাঁদাবাজ সংগঠন তাদের চাঁদাবাজ আটক হলে এর বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া জানাবে এটাই স্বাভাবিক বিষয়। সাধারণ মানুষ জানে ইউপিডিএফ-জেএসএস এর চাঁদাবাজি এবং অত্যাচার সম্পর্কে।
পক্ষান্তরে সেনাবাহিনীর সদস্যরা পার্বত্য অঞ্চলে যে উন্নয়ন করেছেন তার উদাহরণ ও বিবরণ বিশদ।শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের পর থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত সরকারি উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় নিরাপত্তা বাহিনীর স্পেশাল ওয়ার্কস অর্গানাইজেশন বা ইঞ্জিনিয়ার কনষ্ট্রাকশন ব্যাটালিয়নসমূহ পার্বত্য এলাকায় সড়ক অবকাঠামো উন্নয়নে ব্যাপক কাজ করেছে। পার্বত্য অঞ্চলে স্বাধীনতার আগে ১৯৭০ সালে মাত্র ৪৮ কি.মি. রাস্তা ছিল। কিন্তু স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ সরকার পার্বত্য অঞ্চলে নির্মাণ করেছে প্রায় ৩০০০ কি.মি. রাস্তা, অসংখ্য ব্রিজ ও কালভার্ট। পাশাপাশি পার্বত্য চট্টগ্রামে তিনটি স্থল বন্দর নির্মাণ এবং টেলিযোগাযোগের ব্যাপক উন্নয়নের ফলে বাণিজ্য এবং যোগাযোগের ক্ষেত্রেও প্রভূত উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা এবং জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে দেশি এবং বিদেশি এনজিওসমূহের কার্যক্রম, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, পার্বত্যাঞ্চলে সীমান্ত সড়ক নির্মাণ, ভারত ও মিয়ানমারের সাথে যোগাযোগ সড়ক, অরক্ষিত সীমান্ত অঞ্চলের নিরাপত্তা বিধান, অস্থায়ী সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহার, পার্বত্যাঞ্চলে মোতায়নরত সেনাবাহিনীকে ছয়টি স্থায়ী সেনানিবাসে প্রত্যাবর্তন, সামাজিক উন্নয়ন ও বিদ্যুৎ উন্নয়নসহ প্রয়োজনীয় সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। এক পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় ৩ পার্বত্য জেলায় ৫০ হাজার ৮৪৭ জনকে বয়স্ক ভাতা, ৩০ হাজার ৪১০ জনকে বিধবা ভাতা, ৯ হাজার ৩১১ জনকে অসচ্ছল প্রতিবন্ধী ভাতা এবং এক হাজারের বেশি প্রতিবন্ধীকে শিক্ষা উপবৃত্তি প্রদান করা হয়েছে। একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের আওতায় এ অঞ্চলে ১ হাজার ৪৬টি সমিতির মাধ্যমে ৫২ হাজার ১৭২ জন সদস্যের দারিদ্র্য বিমোচন তথা জীবনমান উন্নয়ন করা সম্ভব হয়েছে। এছাড়া আশ্রায়ন প্রকল্পের মাধ্যমে ৭০০টি পরিবারকে পুনর্বাসিত করা হয়েছে। শিক্ষার ক্ষেত্রেও পার্বত্য চট্টগ্রামে উন্নয়নের ছোঁয়া ব্যাপকভাবে লেগেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে কোন বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ ছিলো না। সরকার ২০১৭ সালে সেখানে ১টি বিশ্ববিদ্যালয় এবং ১টি মেডিকেল কলেজ স্থাপন করেছে। আশির দশকে যেখানে উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজের সংখ্যা ছিলো মাত্র ১১টি সেটা এখন ৪৭৯টি, প্রায় প্রতিটি পাড়ায় প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে। শিক্ষার হার ২ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমানে ৪৪.৬২ শতাংশে এ পৌঁছেছে। যেখানে বাংলাদেশের জাতীয় শিক্ষার হার ৫৯.৮২ শতাংশ সেখানে পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমা জনগোষ্ঠীর শিক্ষার হার ৭৩ শতাংশ এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত বাঙালিদের শিক্ষার হার ২৩%। এছাড়াও, পার্বত্য চট্টগ্রামে কারিগরী প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ১টি থেকে ৩টি করা হয়েছে, হাসপাতালের সংখ্যা ৩টি থেকে ২৫টিতে উন্নীত হয়েছে। যেখানে কোনো খেলার মাঠ ছিলো না বর্তমানে সেখানে ৫টি স্টেডিয়াম নির্মিত হয়েছে। কলকারখানা, ক্ষুদ্র কুটির শিল্প ১৯৩টি থেকে বৃদ্ধি পেয়ে এখন ১৩৮২টিতে উন্নীত হয়েছে। ফলে সরকারের উন্নয়ন প্রচেষ্টায় পার্বত্য চট্টগ্রামে এককালের পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রভূত উন্নতির ছোঁয়া লেগেছে। আর এসবই সম্ভব হয়েছে ১৯৯৭ সালে শান্তি চুক্তি সম্পাদিত হয়েছিল বলেই। অর্থাৎ শান্তি চুক্তির গুরুত্ব দেখা যায় তুলনামূলক এসব উন্নয়ন চিত্রে। একইসঙ্গে সামগ্রিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে সেনাবাহিনী সদস্যদের আন্তরিক প্রচেষ্টা পার্বত্য চট্টগ্রামকে যে পাল্টে দিয়েছে সে কথা সকলেই স্বীকার করেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পার্বত্য শান্তি চুক্তির মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামে সৃষ্ট দু’দশকের বেশি সময় ধরে চলমান রক্তক্ষয়ী সংঘাতের অবসান ঘটেছিল ঠিকই কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (পিসিজেএসএস)-এর হঠকারিতার ফলে পুনরায় ওই এলাকা সন্ত্রাসের জনপদে পরিণত হতে চলেছে। পার্বত্য শান্তিচুক্তি অনুযায়ী বাস্তবায়িত উল্লেখযোগ্য বিষয়সমূহ হলো-পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় ও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ গঠন।এছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলায় পার্বত্য জেলা পরিষদ গঠন করা হয়েছে এবং চুক্তি অনুযায়ী কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এ চুক্তি অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড গঠন করা হয় এবং উন্নয়ন বোর্ডের মাধ্যমে বহুমুখী উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে।উপরন্তু পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন গঠন করা হয়েছে।শান্তিচুক্তি অনুযায়ী ১২,২২৩টি উপজাতীয় শরণার্থী পরিবারকে প্রতিশ্রুত সুযোগ-সুবিধাসহ সরকার কর্তৃক পুনর্বাসন সম্পন্ন হয়।বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীতে নিয়োগদানের মাধ্যমে পুনর্বাসন করা হয়েছে শান্তিবাহিনীর ৭১৫ জন সদস্যকে।অন্যদিকে আত্মসমর্পণকৃত শান্তিবাহিনীর ১৯৮৯ জন সদস্যের প্রত্যেককে পঞ্চাশ হাজার টাকা করে অনুদান প্রদান করা হয়। শান্তিচুক্তি অনুযায়ী সরকারি, আধা-সরকারি ও স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানে চাকরির ক্ষেত্রে পার্বত্য উপজাতীয়দের কোটা সুবিধাসহ অগ্রাধিকার প্রদান করা হয়েছিল।শিক্ষাক্ষেত্রে কোটা সুবিধা ছাড়াও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর নিজ ভাষায় প্রাক-প্রাথমিক ভাষায় শিক্ষা চালু ও প্রধান ৭ টি পাহাড়ি নৃ-গোষ্ঠীর শব্দকোষ প্রকাশিত হয়েছে।এছাড়াও সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহারের বিষয়টি গুরুত্বসহ আমলে নিয়ে তা বাস্তবায়ন করা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে পাহাড়ি-বাঙালির মধ্যে উন্নয়নের সেতুবন্ধন সৃষ্টি হওয়ায় এবং উভয়গোষ্ঠীর মধ্যে সুসম্পর্কের পরিসর বৃদ্ধি পাওয়ায় শান্তির জনপদে পরিণত হয়েছিল পার্বত্য এলাকা। দুঃখজনক হলেও সত্য সেই সুখকর পরিস্থিতি বজায় রাখা এখন চ্যালেঞ্জের মুখে।
১৯৭০ সালে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে নিয়ে ভ্রমণের সময় পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়ে ওই এলাকার ভূ-বৈচিত্র্য, নৈসর্গিক সৌন্দর্য এবং সেখানে বসবাসকারী নানা সম্প্রদায়ের বিষয়ে জানার সুযোগ হয় শেখ হাসিনার। যা তাঁকে ওই অঞ্চলের জনগণের কল্যাণে কার্যক্রম গ্রহণে অনুপ্রাণিত করে। এজন্য শান্তির অগ্রদূত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পার্বত্য শান্তিচুক্তির পুরোপুরি বাস্তবায়নে সব পক্ষকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, কেবল ভূমি সংস্কার ব্যতীত পার্বত্য শান্তিচুক্তির অধিকাংশই বাস্তবায়িত হয়েছে। শান্তিচুক্তি অনুযায়ী সেনা ক্যাম্পগুলোর অধিকাংশই তুলে নেওয়া হয়েছে। পার্বত্য অঞ্চলের চারটি জায়গায় কেবল সেনাবাহিনীর চারটি ব্রিগেড থাকবে, বাকিগুলো পর্যায়ক্রমে সব সরিয়ে নেওয়া হবে। পার্বত্য অঞ্চলের মানুষ আরও সুন্দরভাবে বসবাস করবেন এবং তাদের আর্থ-সামাজিক আরও উন্নয়ন হবে- সেই লক্ষ্য নিয়েই সরকার ক্ষমতার ১৮ বছর কাজ করেছে। পাহাড়ের ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তিতে আইন সংশোধনের ওপর জোর দিয়ে প্রধানমন্ত্রী আরো বলেছেন, ভূমি সংস্কার কমিশন বার বার গঠন করা হচ্ছে। কিন্তু এই কমিশনের কাজটা ঠিকমতো হচ্ছে না। সরকার ভূমি সংস্কারের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি কমিশন একাধিকবার গঠন করলেও কমিশনের কাজ সন্তোষজনকভাবে এগোয়নি। কারণ সেখানে কিছুটা অবিশ্বাস এবং দ্বিধা-দ্বন্দ্ব কাজ করছিল। তবে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমেই এই অবস্থা থেকে উত্তরণ সম্ভব। পার্বত্য চট্টগ্রাম আইন-২০০১-এর কতিপয় সংশোধনীর দাবি মেনে নেওয়া দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব এবং সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যে সম্ভব বলেও মনে করেন তিনি। প্রথম থেকেই বিএনপি পার্বত্য শান্তিচুক্তির বিরোধিতা করেছিল। পার্বত্য শান্তিচুক্তির অংশ হিসেবে যখন অস্ত্র সমর্পণের আয়োজন করা হয়, তখন বিএনপি হরতাল ডেকে বলেছিল অস্ত্র সমর্পণ করা যাবে না। খালেদা জিয়া’র মন্তব্য ছিল, এই চুক্তি হলে ফেনী থেকে পুরো পার্বত্যাঞ্চল ভারতের নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে। কিন্তু সেসব কথা অসার প্রমাণিত হয়েছে। বরং শান্তিচুক্তির ফলে পাহাড়ে বাঙালি ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সুসম্পর্ক এবং সৌহার্দ্য বিরাজ করছে।
কিন্তু বাঙালি ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর এই সুসম্পর্ক এবং সৌহার্দ্য বিনষ্ট করছে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (পিসিজেএসএস)-এর সদস্যরা। তাদের অপতৎপরতায় পাহাড়ি ও বাঙালির শান্তি বিঘ্নিত হচ্ছে। সুস্থ ও সুন্দর জীবনের প্রত্যাশা নিয়ে যারা পার্বত্যাঞ্চলে বসবাস করতে চান তাদের পক্ষে দাঁড়ানোর সময় এসেছে। এজন্য পাহাড়ে সাম্রাজ্য গেড়ে বসা সন্ত্রাসবাদকে উচ্ছেদ করতে হবে কঠোরহস্তে। সমস্ত অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করে সন্ত্রাসীদের বিচারের সম্মুখীন করা হলে পার্বত্য এলাকায় শান্তি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।এ বিষয়ে সেনাবাহিনীকে ফ্রন্টলাইনে এসে ভূমিকা পালন করতে হবে।
লেখক : ড. মিল্টন বিশ্বাস, চেয়ারম্যান ও অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, এবং বঙ্গবন্ধু গবেষক, বিশিষ্ট লেখক, কবি, কলামিস্ট, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রগতিশীল কলামিস্ট ফোরাম, নির্বাহী কমিটির সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ
সূত্রঃ দৈনিক ইত্তেফাক