রাঙামাটি । বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪ , ৩ আশ্বিন ১৪৩১

কাপ্তাই প্রতিনিধিঃ-

প্রকাশিত: ১৩:০৬, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪

আপডেট: ১৩:০৭, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪

আধুনিকতার ছোঁয়ায় হারিয়ে যেতে বসেছে পাহাড়ের ঐতিহ্যবাহী “মাচাং ঘর”

আধুনিকতার ছোঁয়ায় হারিয়ে যেতে বসেছে পাহাড়ের ঐতিহ্যবাহী “মাচাং ঘর”
পাহাড়ের ঐতিহ্যবাহী মাচাং ঘর (কাপ্তাইয়ের চিৎমরম ইউনিয়ন থেকে তোলা ছবি)। 

পার্বত্যাঞ্চলে বসবাসকারী উপজাতীয় সম্প্রদায়ের রয়েছে নিজস্ব আলাদা সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য। যা তারা বহু বছর ধরে লালন করে আসছে। তেমনি পাহাড়ে বসবাসরত মারমা সম্প্রদায়ের রয়েছে ঐতিহ্যবাহী অপরুপ নান্দনিক ঘর। সাধারনত এগুলি মাচাং ঘর নামেই পরিচিত। বর্তমানে তিন পার্বত্য জেলা শহর ছাড়াও আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে দূর্গম পাহাড়ী জনপদেও। আর এই আধুনিকতার ছোঁয়ায়ই হারিয়ে যেতে বসেছে ঐতিহ্যবাহী “মাচাং ঘর”। তবে শহর এলাকায় এসব ঘরের দেখা পাওয়া না গেলেও পার্বত্য এলাকার মারমা অধ্যুষিত বিভিন্ন পাহাড়ের দুর্গম অঞ্চলে এখনো মাচাং ঘরের দেখা পাওয়া যায়।

সংশ্লুষ্ট সূত্রে জানা গেছে, মারমা সম্প্রদায়ের এসব মাচাং ঘরের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে- ঘরগুলো সাধারনত তৈরি হয় ছন দিয়ে। ছনের মাচাংগুলো দেখতে যেমন সুন্দর, আকর্ষণীয়, তেমনি শীতল ও আরামদায়ক। পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে ছন দিয়ে মাচাং ঘর তৈরি করে এখনো অনেক পরিবার বসবাস করছে। এসব মাচাং ঘরগুলো দেখলেই মনে হবে কোন শিল্পীর নিপুণ হাতে আঁকা নকশার আদলে তৈরি করা হয়েছে। এই ঘরগুলো পার্বত্য চট্টগ্রামের ঐতিহ্যের সাথে মিলেমিশে আছে। পাহাড়ের ঢালে গড়ে উঠা ছোট-ছোট উপজাতীয় পাড়াগুলোতে একত্রিত ভাবে দেখা যায় এসব মাচাং ঘর।

মাচাং ঘরের ঐতিহ্য হিসেবে আরও জানা গেছে, আদিকাল থেকে পাহাড়ি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী পরিবার গুলো বন্যপশু ও জীবজন্তুর আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে মাচাং ঘরে বসবাস করছে। মাচাং ঘরগুলো সাধারণত মাটি থেকে ৫-৬ ফুট উঁচুতে তৈরি হয়। আর মাচাং তৈরির একমাত্র উপকরণ পাহাড়ি ছন ও বাঁশ। তাই একসময় পার্বত্যাঞ্চলে ছনের ব্যাপক কদর ছিল। কিন্তু কালের বিবর্তন ও অবাধে জুম চাষের কারণে ছনের উৎপাদন কমে যাওয়ায় আজকাল জঙ্গলে বাঁশ এবং ছনের দেখা পাওয়া যায় না। বাজারে কিনতে পাওয়া বাঁশের দাম অনেক বেশি, তাই এখন মাচাং ঘরের সংখ্যাও দিনদিন কমে যাচ্ছে।

মাচাং ঘরে দীর্ঘদিন বসবাস করে আসা কাপ্তাইয়ের চিৎমরম ইউনিয়নাধীন চাকুয়া পাড়ার বাসিন্দা চাউ চিং মারমা, মায়াপ্রু মারমা বলেন, সম্পূর্ণ বাঁশ, গাছ আর ছন দিয়েই তৈরি হতো মাচাং ঘর। ঘরের মূল খুঁটিগুলো হয় গাছ দিয়ে। আবার অনেক ক্ষেত্রে বড় বড় বাঁশেও খুঁটি তৈরি হয়ে থাকে। মাচাংয়ের সাথে খুঁটির যে সন্ধি বা সংযোগ রয়েছে, সেগুলো বাঁধাই করা হতো বাঁশের বেত দিয়ে। অল্প বয়সী কঁচি বাঁশ দিয়ে তৈরি করা হয় এই বেত। বাড়ির মাচাংকে ধরে রাখতে মাচাংয়ের সমান্তরাল বাঁশের সঙ্গে খুঁটির প্রত্যেকটি সন্ধিতে মাটি থেকে দেওয়া হতো ঠেঁস। কাঠ, বাঁশ আর ছন দিয়ে তৈরি মাচাং ঘর এখন তেমন দেখা যায় না। বাঁশ, বেত আর খুঁটির দাম বেশি হওয়ায় মাচাং ঘরের প্রতি অনেকের আগ্রহ কমে যাচ্ছে।

কাপ্তাইয়ের রাইখালী ইউনিয়নের বাসিন্দা সানুপ্রু মারমা, রেমাকি মারমা জানান, মাচাং ঘর আমাদের ঐতিহ্য। কালের বিবর্তনে এটি বর্তমানে কমে আসলেও এখনো মাচাং ঘরের প্রতি আমাদের মতো অনেকের ভালোবাসা রয়েছে। তাই অনেকেই এখনো এসব ঘরে বসবাস করছে। তবে মাচাং ঘরের একটা সমস্যা হচ্ছে এই ঘর তৈরিতে বর্তমানে ২ থেকে ৩ লাখ টাকা খরচ হয়। কিন্তু ঘরগুলো ২-৩ বছরের বেশি টিকে না। তাছাড়া বনজঙ্গলে প্রতিনিয়ত উজাড় হচ্ছে প্রচুর গাছ-বাঁশ। তাই খরচ একটু বেশি হলেও স্থায়িত্বের কথা ভেবে অনেকেই ইট-পাথরের ঘর তুলতে আগ্রহী হচ্ছে। তবে বিভিন্ন সমস্যা থাকা সত্ত্বেও এই মাচাং ঘর আমাদের মারমা সম্প্রদায়ের ঐতিহ্য। তাই এই মাচাং ঘরের সংস্কৃতি হারিয়ে যেতে দেওয়া যাবেনা। এই ঐতিহ্য আমাদের ভবিষ্যতেও টিকিয়ে রাখতে হবে।

প্রসঙ্গত, বিগত সরকারের আমলে পাহাড়ের এই মাচাং ঘরের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি ধরে রাখতে কাপ্তাই উপজেলায় প্রায় ৪০টি পরিবারকে বিনামূল্যে মাচাং ঘর উপহার দেওয়া হয়েছিল। যে ঘরগুলোতে বর্তমানে অসহায় পরিবারগুলো বসবাস করছে।

সম্পর্কিত বিষয়: