ক্ষণে ক্ষণে উড়াই তোমার নিশান
সংকটে বা প্রয়োজনে আমরা স্মরণ করি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। তাকে বাংলাদেশের রূপকার বা রাষ্ট্রনায়ক হিসেবেই বর্ণনা করা হয়।
বঙ্গবন্ধুর কীর্তি ও ভাবনা এই মহাদেশের শান্তি ও প্রগতির সঙ্গে এতটাই সংপৃক্ত যে আজ বারেবারে তার চিন্তা ও দিগনির্দেশ মনের তন্ত্রীতে ঝংকার তুলছে। যে প্রসঙ্গের অবতারবনা করতে চাইছি তা হল ধর্মনিরপেক্ষতা। আজ সরস্বতী পূজার অংশবিশেষ ৩০ তারিখে হওয়ার কারণে যে উদারতা দেখিয়ে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন ঢাকার মেয়র নির্বাচনের তারিখ পিছিয়ে দিলেন তা দেখে বোঝা গেল যে বঙ্গবন্ধুর অসাম্প্রদায়িকতার রাজনীতি ভারতীয় উপমহাদেশে নতুন প্রজন্মের কাছে একটা বিশেষ অর্থ বহন করছে এবং তার প্রদর্শিত পথে চলেছে বাংলাদেশ।
সাম্প্রদায়িকতা বিষয়ে বঙ্গবন্ধুর ভাবনা যে কয়েক যোজন এগিয়ে ছিল তা এখন আমরা টের পাচ্ছি। অল্পবয়েসে নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর প্রভাব তার ওপরে ছিল। তারপরে পিতা লুৎফর রহমান ও পরে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর কাছে তার রাজনৈতিক শিক্ষা। মাত্র ২৫ বছর বয়েসে ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে’ পালনের সময় দেখেছেন কলকাতার দাঙ্গা। তারপরে দেখেছেন বিহারের দাঙ্গা। ধর্মীয় সংঘাত যে সাধারণ মানুষের জীবনে কী দুর্বিসহ দুর্দশা আনে তা দেখেছেন নিজের চোখে। ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ চাইলেও তিনি দুই সম্প্রদায়ের মানুষের মূলোৎপাটন চান নি। চেয়েছিলেন অখণ্ড বাংলা। জড়িত ছিলেন সেই কর্মযজ্ঞে। দেখলেন কীভাবে সাধারণ মানুষের দুর্দশা এড়ানোর পথ বন্ধ করলেন কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। পেল না অখণ্ড বাংলা। দেশভাগের পরে কলকাতার আত্মজ শেখ মুজিব যখন কলকাতা ত্যাগ করলেন। তার বয়সে মাত্র ছাব্বিশ। হাজির হলেন এক অচেনা শহরে। তার নাম ঢাকা। তিনি ছিলেন কলকাতার শের। তিনি ছিলেন মুসলিম লীগ কাউন্সিলের মেম্বার। কাজেই পূর্ব-পাকিস্তানে গিয়ে রাশ তুলে নিলেন নিজের হাতে।
তার নেতৃত্বে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পরেই অসাম্প্রদায়িক ছাত্র সংগঠন রূপে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন আত্মপ্রকাশ করে। একই ধারায় পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের নাম থেকে এবং পরবর্তীতে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের নাম থেকে মুসলিম শব্দ বাদ দেয়া হয়। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রথম শাসনতন্ত্র প্রণয়নের সময় গণপরিষদে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রের ইসলামী প্রজাতন্ত্র নামকরণের তীব্র বিরোধিতা করে। ১৯৬৯ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহারের বিরুদ্ধে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেন। ১৯৭০ সালে জেনারেল ইয়াহিয়া খান ঘোষণা করেন পাকিস্তানের রাষ্ট্রপ্রধান হবেন একজন মুসলমান। সে বছর সেপ্টেম্বরে ছাত্রলীগ ইয়াহিয়া খানের উক্ত ঘোষণা সম্পর্কে আপত্তি জানায়। ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ছাত্র ইউনিয়ন প্রস্তাব করে ‘রাষ্ট্র হইবে ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র’। পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতিরূপে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করে রেসকোর্সের জনসমুদ্রে বঙ্গবন্ধু সুদৃঢ় কণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন বিশ্বের বৃহত্তম মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ ‘বাংলাদেশ’ রাষ্ট্রের ভিত্তি হবে গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। কাজেই দেখা যায়, ১৯৭২ সালের সংবিধানের মূল চার ভিত্তির যুক্তিসঙ্গত, ঐতিহাসিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ভিত্তি রয়েছে। বাংলাদেশের জনগণের চাওয়া-পাওয়ার হিসাব এর মধ্যে নিহিত রয়েছে।
বঙ্গবন্ধুর ভাবনা অনুযায়ী রাষ্ট্র ধর্ম বিষয়ে নিরপেক্ষ থাকবে। রাষ্ট্রের সকল নাগরিক যাতে তাদের পছন্দমতো ধর্ম পালন করতে পারেন তা দেখবে রাষ্ট্র। ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ এই নয় যে, রাষ্ট্র ধর্মবিরোধী হবে অথবা রাষ্ট্রে ধর্মের কোনো স্থান থাকবে না। বরং সব ধর্মের অবাধ বিচরণভূমি হবে দেশ। আভিধানিক অর্থে ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে এটা বোঝায় যে রাষ্ট্র ধর্মীয় বিষয়ে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষতা বজায় রেখে চলবে। যেহেতু, ধর্ম প্রতিটি মানুষের যাপনের বিষয় সেহেতু রাষ্ট্র ধর্মীয় বিষয়ে কোনও হস্তক্ষেপ করবে না সেটাই বাঞ্ছনীয়। এটার মানে দাঁড়ায় যে যদি কোনো মানুষ নিজের ধর্ম পালন করেন, তার এ-ও দায়িত্ব বর্তায় তার পাশের মানুষটি যদি অন্য ধর্মের হন তা হলে তিনিও যেন নিজ ধর্ম পালন করতে পারেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর এই ভাবনাকে পালটে ফেলা হল তার শাহাদাতের পরে। তার প্রথম ধাপ হচ্ছে ১৯৭৮ সালের ৫ম সংশোধনী। উক্ত সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের শুরুতেই ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ যুক্ত করা হয়। ১৯৮৮ সালের ৮ম সংশোধনীর মাধ্যমে আরো এক ধাপ এগিয়ে ইসলামকে প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম করা হয়। তখন এ ব্যাপারে একক ও সমষ্টিগতভাবে ৩টি মামলা হাইকোর্টে রুজু হয়েছিল। ২০১১ সালে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের চার মূলনীতি ফিরিয়ে আনা হলেও ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ ও রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলামকে বহাল রাখা হয়। তবে সুকৌশলে সংবিধানে বিসমিল্লাহর পাশাপাশি ‘পরম করুণাময় সৃষ্টিকর্তার নামে’ লাইনটি যুক্ত করা হয়। এটা ক্ষুব্ধ করল অন্য সম্প্রদায়কে। উৎসাহিত করল গোঁড়া মুসলমানদের। কীভাবে?
২০০১ সাল থেকে প্রায় ১০ বছর সংখ্যালঘুদের স্রোত ছিল ভারতমুখী। ২০০১ সালের নির্বাচনের পর বাংলাদেশের বরিশাল, বাগেরহাট, পাবনা ও নড়াইলসহ বিভিন্ন জেলায় ব্যাপকসংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা ঘটে৷ এরপর থেকে একযোগে বিভিন্ন সংখ্যালঘু নির্যাতন কমে এলেও তা থামেনি৷ ২০১২ সালের অক্টোবরে কক্সবাজারের রামুতে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ওপর বড় ধরনের হামলা হয়৷ কিন্তু তারপরে? ক্রমে ক্রমে কমে তা বর্তমানে প্রায় শূন্যে এসে ঠেকেছে।
পালটা কি দেখছি ভারতে? নবলব্ধ হিন্দুত্বের সঙ্গে মিশেছে উগ্র জাতীয়তাবাদ। হিন্দুরা বিশ্বাস করেছে রাজ্যে মুসলমান জনসংখ্যা এমনভাবে বাড়ছে যে কিছু দিনের মধ্যে হিন্দুরা সংখ্যালঘু হয়ে যাবে। ঈশ্বরের নামে ধ্বনি দিয়ে মুসলমান মারো। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের সংখ্যালঘু নীতি এ সব ভ্রান্ত বিশ্বাসকে আরো দৃঢ় করেছে। মুসলমানকে সামাজিক মর্যাদায় প্রতিষ্ঠা করার জন্য দরকার শিক্ষার বিস্তার আর অর্থনৈতিক মানোন্নয়ন। সেই কষ্টকর পথে না হেঁটে সরকার মুসলমানকে খুশি করার সহজ পথটাই বেছে নিয়েছেন— জেলায় জেলায় মাদরাসার বড় বড় বাড়ি বানিয়েছেন। সদিচ্ছা, অর্থের জোগান আর পরিকাঠামোর অভাবে সেগুলো কার্যত অচল। শিক্ষিত মুসলমান মধ্যবিত্তের কর্মসংস্থানের কথা না ভেবে ইমাম মুয়াজ্জিনদের ভাতার ব্যবস্থা করেছেন। গড় হিন্দু বাঙালির চোখে মুসলমানের যে মিথ্যা ছবি আঁকা ছিল তা আরো পোক্ত হয়েছে। তার মধ্যে এসেছে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন। বিবেকানন্দ মনে করতেন, সব ধর্মই সমান সত্য। অরবিন্দের বক্তব্য ছিল, ‘রিলিজন’ শব্দটির কোনও সংস্কৃত প্রতিশব্দ নেই। ‘ধর্ম’ কথাটার অর্থ অনেক বড়।
এখন ধর্মনিরপেক্ষতা’ শব্দটি এই উপমহাদেশে বৃহত্তম মিথ্যা। ভারতীয় সংবিধানের ৪২তম সংশোধনী অনুযায়ী ভারত ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র, ‘সেকুলার’। সংবিধানের ২৭ নম্বর ধারা বলছে, ‘কোনো বিশেষ ধর্মের প্রসার বা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কোনো নাগরিককে কর দিতে বাধ্য করা যাবে না। ‘ভারতে ধর্মের নামে কর ধার্য করা হয়নি ঠিকই, কিন্তু এটাও তো ঠিক যে প্রদত্ত কর ধর্মীয় উৎসবে ব্যবহার করা হচ্ছে, করদাতাদের অনুমতি ব্যতিরেকেই! রাষ্ট্রের পাহারাদার হওয়ার কথা ছিল, সে হয়েছে ঠিকাদার।
বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত ইসলামিক রাজনৈতিক দল হলো ১০টি৷ এর বাইরে আরো শতাধিক ইসলামি রাজনৈতিক দল আছে৷ ৫০টি হিন্দু রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের সমন্বয়ে আছে বাংলাদেশ জনতা পার্টি বা বিজেপি৷ যদিও সমাজতাত্ত্বিকদের একটি অংশ মনে করেন, সেকুলারিজম-এর যে ধারণাটি প্রচলিত হয়েছে, তা পশ্চিম থেকে নেয়া, উপমহাদেশের মানসের সঙ্গে আসলে কোনো দিন সম্পৃক্ত হতে পারেনি। অথচ পৃথিবীর ১৩টি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে রাষ্ট্রীয় নীতি হিসেবে ধর্ম নিরপেক্ষতা সন্নিবেশিত আছে। দেশগুলো হলো- নাইজারিয়া, সেনেগাল, তুরস্ক, তাজিকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, কিরগিজস্তান, কসোভো, কাজাখস্তান, গায়ানা, চাদ, আজারবাইজান, মালি ও বারকিনো ফাসো। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এ দেশগুলোর কোনোটিতেই সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্মের অজুহাত তুলে সংবিধানে রাষ্ট্রধর্মের বিধান রাখা হয়নি। বিশ্বে আরো সাতটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে রাষ্ট্র কর্তৃক অগ্রাধিকার প্রাপ্ত কোনো ধর্ম নেই।
দেশগুলো হচ্ছে- ইন্দোনেশিয়া, গাম্বিয়া, লেবানন, আলবেনিয়া, সিরিয়া, উজবেকিস্তান এবং সিয়েরালিয়ন। খোদ আরব অঞ্চলের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোতেও ধর্মনিরপেক্ষতা বিদ্যমান। ইসলামি রাষ্ট্রসংস্থার (ওআইসি) অর্ধেক সদস্য রাষ্ট্রেরই কোনো রাষ্ট্রধর্ম নেই। সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইন্দোনেশিয়া এবং সিরিয়ার মতো দেশ রাষ্ট্রধর্মে বিশ্বাস করে না। অন্যদিকে তুরস্ক কেবল ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রই নয়, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ তুরস্কের সংবিধানে কোনোমতেই সংশোধনযোগ্য নয়। ফরাসী বিপ্লবের আদর্শই ফ্রান্সকে ধর্মনিরপেক্ষ থাকার প্রেরণা দিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও কোনো রাষ্ট্রধর্ম নেই।
পাকিস্তান সবসময়েই ধর্মের জাঁতাকলে ঘুরে মরেছে। সংশোধনযোগ্য ওরা নয়। কিন্তু ভারত? এই মুহূর্তে ধর্মের রমরমা। বাংলাদেশ? আজ তারা যে উদাহরণ খাড়া করল ভারতীয় উপমহাদেশে তা যুগান্তকারী , অসাধারণ , অনন্য। এই সিদ্ধান্ত দেখে বারেবারে মনে পড়ছে বঙ্গবন্ধুর কথা। মনে হচ্ছে তাকে সমর্পিত একটি কবিতার শেষ স্তবক - কেন তা জানি না, কুহকের মসৃণে/ মৃত্যুর কাছে ফেলে রাখা কিছু ধার/ মেটাতে হবে তা দিনবদলের দিনে/ তোমার নিশান আজ বড় দরকার।
আলোকিত রাঙামাটি